শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার, ছয়গাও ইউনিয়নের আটেরপাড়া গ্রাম — যেন নৌকা তৈরির এক বিশাল কারখানা। কাজের দক্ষতা ও একাধিক নৌকা তৈরির কারখানা, স্থানীয় ভাষায় (তফিল) থাকায় এই গ্রামেটি এখন নৌকা গ্রাম নামে পরিচিত। ছোট-বড় মিলিয়ে এই গ্রামে প্রায় শতাধিক তফিল রয়েছে। বর্তমানে এই গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ কারিগর ফেলু বাইন। যার দাদা সর্বসাধু বাইনের হাত ধরে প্রায় দুইশো বছর আগে, ছোট্ট একটা মালাই নৌকা দিয়ে শুরু হয়, তফিলে নৌকা বানানোর কাজ। তখন মাসে ৩ থেকে ৪ টি বড়ো নৌকা এবং ৮ থেকে ১০ টি ছোট নৌকা বানানো হতো। পরবর্তীতে সর্বসাধু বাইনের ছেলেদের হাতধরে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে এই পেশা। যার ঐতিহ্য সর্বসাধু বাইনের নাতি ফেলু বাইন, অতঃপর তাদের পরবর্তী প্রজন্মও এখনো টিকিয়ে রেখেছে সম্মানের সাথে।

আঁটিপাড়া স্কুল থেকে নৌকা গ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়বে, সারি সারি কাঠের গুঁড়ি, হাতুড়ি-পেরেকের টুংটাং শব্দ, করাতের ঘর্ষণ আর উড়তে থাকা কাঠের গুঁড়োয় বেঁচে থাকা অভিজ্ঞ কারিগরদের ব্যস্ততা। বর্ষা আসলেই যেন এই গ্রামটি নৌকা বানানোর উৎসবের গ্রাম হয়ে ওঠে। বানিজ্যিক পরিমন্ডলে এখানে তৈরি হয় ছোট থেকে বড়, বিভিন্ন আকার-আকৃতির কাঁঠের নৌকা। যা স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়।

এই গ্রামের মানুষের জীবনের সঙ্গে নৌকার সম্পর্ক কয়েক প্রজন্মের। প্রায় ২০০ বছর ধরে গ্রামের শতাধিক পরিবার এই পেশায় জড়িত থাকায়, এটি কেবল ঐতিহ্যই নয়, বরং জীবনধারণের অবলম্বনও বটে। ফলে আজকের দিনেও বংশ পরম্পরায় এই পেশা ধরে রেখেছেন অনেকে। গ্রামের তফিল গুলোতে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই বাবার কাজে হাত লাগিয়ে শিখে নেয় কাঠ কাটা, মাপ নেওয়া, আর নৌকা তৈরির টুকিটাকি কৌশল। অতঃপর বয়সের সাথে সাথে অভিজ্ঞতার যোগ হলে, নিজেরাই গড়ে নেন তফিল কিংবা জাড়িয়ে পড়েন কারো না কারো তফিলের দিকে।

নৌকা বানানোর প্রকৃত মৌসুম মুলত বর্ষার আগে। সেসময় গ্রামের প্রতিটি আঙিনা, বাড়ির উঠোনে, এমনকি রাস্তার ধারে চলতে থাকে নৌকা তৈরির কাজ। ভরা মৌসুমে একেকজন দক্ষ কারিগর দিনে একটি ছোট নৌকার কাজ শেষ করতে পারেন। তবে বড় নৌকা বানাতে লেগে যায় ১ থেকে ২ দিন। হাতে বানানো এক একটি ছোট নৌকা বানাতে খরচ হয় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা এবং বিক্রি হয় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা বাজার দরে। অপরদিকে একটি বড় নৌকা বানাতে খরচ হয় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা, যা বিক্রি হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা বাজার দরে। এতে যতটুকু লাভ হয় এ দিয়েই চলে গ্রামের তফিলদার এবং কাঠমিস্ত্রিদের সংসার। পূর্ন মৌসুমে কেবল এই অঞ্চলের উৎপাদনেই চাহিদা পূরণ হয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হতো এসব নৌকা।

তবে সম্প্রতি নদীনালা ও খালবিল ভরাট হয়ে যাওয়ায়, ভাটা পড়েছে এ পেশায়। নৌকা তৈরির জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও বাড়েনি নৌকার দাম। তাই বাধ্য হয়ে অনেকেই পেশা ছেড়ে চলে গিয়েছেন অন্যত্র। একসময় নৌকা গ্রামে দুই শতাধিক কারখানা থাকলেও এখন টিকে আছে মাত্র শ’খানেক কারখানা। বাংলাদেশের নদীমাতৃক সংস্কৃতিতে নৌকা শুধু পরিবহনের মাধ্যম নয়। এটি গ্রামীণ জীবনের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক। ভেদরগঞ্জের আটেরপাড়া গ্রাম সেই ঐতিহ্যকে আজও ধরে রেখেছে প্রজন্মান্তরে। বিদ্যমান কারিগরদের হাতে, প্রতিদিন তৈরী হচ্ছে নতুন নতুন নৌকা, যা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ জীবনের স্বপ্ন বুনন আর প্রত্যাশার গল্প।

নৌকা গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান দেবাশীষ বাইন বলেন- “বছর দশেক আগে নৌকার খুব চাহিদা ছিলো। বছরে আমাদের গ্রামের কারখানায় প্রায় ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা বিক্রি হতো। এখন তেমন বিক্রি নেই, আনুমানিক সবমিলিয়ে বছরে কোটি টাকার মতো বানিজ্য হয় এখানে। আগে বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে পাইকার সরাসরি আমাদের গ্রামে এসে নৌকা নিয়ে যেতো তখন লাভ বেশি হতো। এখন পাইকার আসে না তাই বাধ্য হয়ে স্থানীয় বুড়িরহাট বাজারে গিয়ে বিক্রি করতে হয় ।”

৮০ বছর বয়সি প্রবীণ নৌকা কারিগর গৌরাঙ্গ বাইন বলেন- “আমি প্রায় ৬৫ বছর ধরে নৌকা বানাচ্ছি। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে কাজ শিখেছি। তখন হাতুড়ি-পেরেকের শব্দেই ঘুম ভাঙত, আর ঘুম হত কাঠের গন্ধে। এক সময় পুরো গ্রামটাই নৌকা বানানোর শব্দে মুখর থাকত। এসময় নৌকার খুব চাহিদা ছিলো। আমি বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে নৌকা বানাতাম। এখন আগের মতো চাহিদা নেই।”

নৌকা কারিগর ফেলু বাইন বলেন- “একসময় খুব অভাব-অনটনে আমাদের দিন পার করতে হতো। আমি যখন দশ-বারো বছরের ছেলে, তখন থেকেই কাকার সঙ্গে কাঠ কাটতাম, পেরেক ঠুকতাম। এখন বয়স হয়েছে, কিন্তু নৌকা বানানোই আমার একমাত্র পেশা। মৌসুমে কাজের চাপ এত বেশি হয় যে, ভোর থেকে রাত পর্যন্ত হাত থামানোর সুযোগ থাকে না। নৌকা বানানো আমাদের রক্তে মিশে আছে। যদি সরকার কিছু সহযোগিতা করত, তাহলে আমরা আরও ভালো মানের নৌকা তৈরি করে দেশের বাইরে রপ্তানি করতে পারতাম।”

শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রশাসনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক ও সমাজ কর্মী টি.এম গোলাম মোস্তফা বলেন- “ভেদরগঞ্জের এই নৌকা শিল্প শুধু একটি পেশা নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অংশ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এখানকার মানুষ নৌকা বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। কিন্তু আধুনিকতার ঢেউ আর বিকল্প পরিবহনের কারণে এই শিল্প হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। তাই প্রশাসনের উচিত কারিগরদের প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে ঋণ ও বাজার ব্যবস্থাপনার সুযোগ করে দেওয়া। এতে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই হবে না, আমরা আমাদের শত বছরের ঐতিহ্যও আগামীর প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করতে পারব।”

ভেদরগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি ও ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মোজাহেরুল হক বলেন- “নৌকা আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভেদরগঞ্জের এই গ্রামে শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখা কারিগররা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। আমরা চাই এই শিল্প আরও প্রসারিত হোক। প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ, বাজার সংযোগ ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানে উদ্যোগ নেওয়া হবে। যাতে এই ঐতিহ্য শুধু টিকে না থাকে, বরং আগামী দিনে আরও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।”

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *